Magic Lanthon

               

মাজিদ মিঠু ও মোহাম্মদ আলী মানিক

প্রকাশিত ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

ইস্যু পরিবর্তনে সংবাদপত্রের আত্মবয়ান

‘কানামাছি ভোঁ-ভোঁ, যারে খুশি তারে ছোঁ’ কিন্তু চোখ খুলে

মাজিদ মিঠু ও মোহাম্মদ আলী মানিক


প্রতিদিন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা সংবাদপত্র পড়ছি। সময় আর আগ্রহের অভাবে সব সংবাদ অবশ্য বিস্তারিত পড়া হয় না। প্রথম পাতার বড়ো অক্ষরের শিরোনামগুলোই আমাদের দৃষ্টিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আকর্ষণ করে। আমরা পড়িও সেগুলোই বেশি; কারণও অবশ্য আছে। বড়ো অক্ষরের শিরোনামগুলো সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের হয়। এবং সাংবাদিকতার চর্চা ও আমাদের দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফলে আমরা প্রায় মেনেও নিয়েছি, প্রথম পৃষ্ঠার শিরোনাম যতো বড়ো, তার তলদেশের সংবাদ ততো গুরুত্বপূর্ণ। এখন যা গুরুত্বপূর্ণ তা সম্পর্কে একটা আগ্রহ জন্মাবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সংবাদপত্রের বড়ো-বড়ো সংবাদের ক্ষেত্রে দেখছি, আগ্রহের জন্ম দিচ্ছে, কিন্তু আগ্রহের পরিতৃপ্তি না ঘটিয়েই সেই সংবাদ বিদায় নিচ্ছে। যে-কেউ ধারাবাহিকভাবে অন্তত প্রথম পাতাটা খেয়াল রাখলে দেখতে পারবেন, মোটা অক্ষরের শিরোনামগুলো প্রতিনিয়তই বদলে যায়। আর যে-কয়দিন থাকে, তাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সংবাদের মধ্যে পাঠকের তৃপ্তি মেটানোর তেমন আগ্রহও দেখা যায় না। এতে যেটা হয়, কোনো বিষয় সম্পর্কে আমাদের চিন্তার খুব বেশি পূর্ণতা আর আসে না। তাহলে কি বুঝবো, সংবাদপত্র এক জায়গায়/এক ইস্যুতে বেশি দিন থাকতে নারাজ কিংবা সংবাদপত্র কি তাদের দৃষ্টিকে সংকুচিত করে রাখে? এই বোঝাপড়া স্পষ্ট করতে আমরা নমুনা হিসেবে প্রথম আলো এবং কালের কণ্ঠ পত্রিকার ২০১২ সালের এপ্রিল ও মে মাসের সংখ্যাগুলো নিয়ে কথা বলতে চাই। তবে তার আগে একটু দেখেনি তত্ত্ব দিয়ে গণমাধ্যমকে কীভাবে দেখা হয়। কারণ, ব্যবহারিকভাবে আজকের আলোচনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে তাত্ত্বিক সমর্থনের প্রয়োজন আছে।

 

২.

বলা হয় গণমাধ্যম হলো সেই মাধ্যম যা যান্ত্রিক পদ্ধতির সাহায্যে উৎপন্ন এবং তৎক্ষণাৎ অথবা অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ের ভেতর যার প্রতিরূপ (reproduction) সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। আর সংবাদপত্র সম্পর্কে বলা যায়, এটি এমনই একটি কার্যকর গণমাধ্যম যা পাঠককে অন্যান্য মাধ্যমের চেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে, ভাবায়। সংবাদপত্রকে এক সময় সমাজের দর্পণ বলা হতো। আজ বলতে হবে, সংবাদপত্র রাষ্ট্র-সমাজ-মানুষের অগ্রবর্তিতার বাতিঘর (আমরা যদিও সমাজের দর্পণ বা বাতিঘর হিসেবে দেখি না, ক্ষমতা-সম্পর্কের ভিতর ক্রিয়াশীল একটা ব্যবসা ও মতাদর্শিক যন্ত্র বিবেচনা করি-সম্পাদক)।

এ ক্ষমতা-সম্পর্কের ভিতর ক্রিয়াশীল একটি ব্যবসা ও মতাদর্শিক যন্ত্র হিসেবে সংবাদপত্র আজ ব্যবহার হচ্ছে প্রভাবশালীদের স্বার্থ রক্ষায়। যারা জনসাধারণের চিন্তা-চেতনাকে শৃঙ্খলিত করে তাদের স্বার্থ উদ্ধারে সবসময় গণমাধ্যমকে ব্যবহার করছে। এডওয়ার্ড বারনেসের কথায়, ‘‘একজন সৈন্য তার দেহকে যেভাবে শৃঙ্খলিত করে রাখে সেভাবে জনগণের মস্তিস্কও শৃঙ্খলিত করে রাখা সম্ভব। অসভ্য মানুষগুলো যেনো সোজা পথে থাকে এটা নিশ্চিত করার জন্য মস্তিস্ক শৃঙ্খলিত করে রাখার নতুন সব কেরামতি অবশ্যই ব্যবহৃত হতে হবে। আর আজকের সময়ে সংবাদপত্র সেই কেরামতির অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেহেতু এর আধেয় পাঠকের চোখের সামনে অন্যান্য গণমাধ্যমের চেয়ে স্থায়ী ও বেশি প্রভাব বিস্তার করে, তাই এটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকার, ক্ষমতাবানের ক্ষমতা সংরক্ষণের হাতিয়ার। আর এটা করতে গেলে তো জনগণকে কোনো বিষয় নিয়ে খুব বেশি দিন ভাবতে দেওয়া ঠিক হবে না। কথায় আছে, ভাবনা-চিন্তাই মুক্তির পথকে সুগম করে। এ-পথ যেনো খোলা না থাকে, তাই তো ঘটনার গভীরে আর যাওয়া হয় না সংবাদপত্রের; তার আধেয়ও পরিবর্তিত হয় নিয়মিত, প্রতিনিয়ত। তাত্ত্বিক এ-পর্যন্তই, এবার আমাদের ব্যবহারিক বক্তব্য শুরু করছি।

 

৩.

প্রথম আলোয় ১৯ এপ্রিল থেকে ৩ মে পর্যন্ত মোট ১৫ দিন; এবং কালের কণ্ঠ-এর ১৯ এপ্রিল থেকে ১০ মে পর্যন্ত মোট ২২ দিন প্রধান ইস্যুতে ছিলো বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজের ঘটনা। এই দুই মাসে সংবাদের সংখ্যা এবং মূল্যায়নের ভিত্তিতে বিচার করলে পত্রিকা দুটিতে তিন-তিনটি প্রধান ইস্যু স্থান পায়। এবং একটি ইস্যু আসার পর আগের ইস্যুটি বন্ধ হয়ে যায়। বিস্তারিত আলোচনা শুরু করা যাক।

প্রথম আলোকালের কণ্ঠ-তে ১১ এপ্রিল থেকে ১৮ এপিল পর্যন্ত আট দিন তৎকালীন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অর্থ-কেলেঙ্কারির বিষয়টি প্রধান ইস্যু হিসেবে স্থান পায়। এই আট দিনে সুরঞ্জিত বিষয়ে কালের কণ্ঠ ৩৬টি এবং প্রথম আলো মোট ৩৫টি সংবাদ প্রকাশ করেছে। এমনকি ইস্যুর শেষ দিনও অর্থাৎ ১৮ এপ্রিল এ-বিষয়ে কালের কণ্ঠ এবং প্রথম আলো-তে যথাক্রমে নয়টি ও ছয়টি করে সংবাদ প্রকাশ হয়। আগের বাক্যে শেষ দিন বলার কারণ, ১৯ এপ্রিল থেকে সুরঞ্জিত ইস্যুটি দুটো পত্রিকা থেকে প্রায় হারিয়ে যায়। ১৯ এপ্রিল মুক্তি পায় বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর গুমের কাহিনী। সে-দিন সুরঞ্জিত বিষয়ে প্রথম আলো ছাপায় এক কলামের একটি এবং কালের কণ্ঠ বিভিন্ন পাতা মিলে চারটি সংবাদ। পরদিন থেকে তা-ও আর থাকে না। চলতে থাকে ইলিয়াসের কাহিনী। যে-কাহিনী ১৬ দিন চালিয়ে প্রথম আলো শেষ করে ৩ মে। আর কালের কণ্ঠ ২৩ দিন চালিয়ে শেষ করে ১০ মে। ইলিয়াসের এই সময়কালে সুরঞ্জিত ইস্যুতে প্রথম আলো ছাপায় মাত্র সাতটি সংবাদ আর কালের কণ্ঠ নয়টি। যার বেশির ভাগই আবার ভিতরের পাতায় এবং এক কলামের। অথচ দেখুন, যে-সংবাদটির ১১ থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত এতো মূল্য ছিলো, নিমিষেই তার মূল্য কীভাবে কমে গেলো! তার মানে দাঁড়ায়, ঘটনার মূল্য বিচার হয়-অন্য নতুন ঘটনার আগমনের ওপর ভিত্তি করে। যে মারপ্যাঁচে কপাল পোড়ে সুরঞ্জিত আখ্যানের, সেই একই মারপ্যাঁচে কপাল পোড়ে ইলিয়াস আখ্যানের। যার পরিসমাপ্তি বাংলাদেশে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের আগমনে।

১৯ এপ্রিল ইলিয়াস গুম হবার পর থেকে ৩ মে পর্যন্ত প্রথম আলো-তে এটি প্রধান ইস্যু হিসেবে উপস্থিত হতে থাকে। প্রথম আলো ওই ১৬ দিনে এবং কালের কণ্ঠর ২৩ দিনে ইলিয়াসকে নিয়ে সংবাদ ছাপায় যথাক্রমে ৮৪টি এবং ১১২টি। এমনকি একদিনে একটি বিষয়ে সর্বোচ্চ ১৩টি সংবাদও ছাপা হয়েছে। হায়রে ইলিয়াস ইস্যু! হিলারি আসলো, আর সঙ্গে সঙ্গে ইস্যুটিকে আকাশ থেকে পাতালে নামিয়ে দেওয়া হলো। হিলারি থাকাকালীন আট দিনে (৩-১০মে) প্রথম আলো-তে ইলিয়াসকে নিয়ে সংবাদ ছাপা হয়েছে ১১টি। ক্যালকুলেটর দিয়ে হিসাব করলে দেখা যাবে, হিলারি আসার আগে প্রথম আলো-তে ইলিয়াস-সংক্রান্ত সংবাদের দৈনিক গড় ৫ দশমিক ২৫টি (৮৪ কে ১৬ দিয়ে ভাগ)। আর হিলারি আসার পর এই গড় গিয়ে নামলো ১ দশমিক ৩৭-এ (১১ কে ৮ দিয়ে ভাগ)।

এই আলোচনায় আমাদের দেখানোর প্রয়াস ছিলো-সংবাদপত্র একের পর এক ইস্যু পরিবর্তন করছে। একটি ইস্যুতে তারা বেশি দিন থাকতে চায় না কিংবা থাকে না। এ-ধরনের অভিযোগ করলে অবশ্য পাল্টা আরেকটি প্রশ্ন ওঠে; নতুন ইস্যু তৈরি হলে সেটিকে ইস্যু বানাবে না কেনো; কিংবা এতে দোষের কী আছে? অবশ্যই বানাবে; ঠিক আছে; সেটা বুঝলাম। কিন্তু বিষয়টা একেবারে সাদা-কালো, ভালো-খারাপের মতো এতো পরিষ্কার নয়। সেটা কেমন? যা ঘটে, তাই তুলে দেওয়া তো সংবাদপত্রের কাজ নয়। এতে হয়তো নিরপেক্ষতার গন্ধ থাকে, কিন্তু দায়িত্বশীলতা বলতে কিছু থাকে না। গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে কিংবা সমাজের বিবেক বলে যে-বিশেষণ দেওয়া হয়, তা-ও কেবলই লেবাসি বক্তব্য হয়ে যায়। আর এতে করে গণমাধ্যম কেবল নিষ্ক্রিয় দর্পণ হিসেবেই প্রতীয়মান হয়, শক্তিশালী কোনো মাধ্যম হিসেবে নয়। এবার প্রশ্ন, এসব অভিযোগের ভিত্তি কী? সেটাও নিশ্চয় আছে, এতোক্ষণ যে-ইস্যু কয়েকটি নিয়ে কথা বললাম, তাতে সংবাদপত্র কেবল নিষ্ক্রিয় দর্পণ হিসেবেই কাজ করেছে। এমনকি মাঝে মাঝে, মোটরসাইকেলের লুকিং গ্লাসের মতো প্রতিফলিত বস্তুর অবয়বের বিকৃতিও ঘটিয়েছে। বিষয়টি খুলে বলা দরকার।  

 

৪.

সুরঞ্জিত-ইস্যুর প্রকাশিত সংবাদের পরিমাণ দেখি। এ-ক্ষেত্রে শেষ দিনের অর্থাৎ ১৮ এপ্রিলের পত্রিকা ধরে কথা বলাটাই মনে হয় প্রাসঙ্গিক হবে। এ-দিন প্রথম আলো-তে এ-বিষয়ে সংবাদ এসেছে মোট ছয়টি ও উপ-সম্পাদকীয় একটি। যার মধ্যে দিনের প্রধান সংবাদসহ প্রথম পাতায় দুটি, শেষের পাতায় একটি, দুইয়ের পাতায় দুটি ও সাত-এর পাতায় একটি। এ-নিয়ে একটি উপ-সম্পাদকীয়ও প্রকাশিত হয়। এবার এ-সংবাদগুলোর শিরোনাম দেখা যাক। প্রথম আলোয় প্রথম পাতার একটি সংবাদের শিরোনাম ছিলো পদত্যাগের পর সুরঞ্জিত এখন দপ্তরবিহীন মন্ত্রী। আরেকটির শিরোনাম ছিলো, ঘটনার বর্ণনা দিলেন এনামুল হক : গাড়িতে অনেক টাকা আছে বলে চেঁচামেচি শুরু করেন চালক। শেষের পাতায় দেড় কলামের সংবাদটির শিরোনাম ছিলো, চালকসহ সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয় : বললেন বিজিবির প্রধান। শেষের পাতাতে আরও দুটি সংবাদ প্রকাশ হয়, একটি এক কলাম অন্যটি দুই কলামের। যার একটির শিরোনাম ছিলো সুরঞ্জিতকে বলির পাঁঠা করে সরকারের শেষ রক্ষা হবে না : সমাবেশে মির্জা ফখরুল। আরেকটি মন্ত্রীর পদত্যাগের ঘটনায় দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়নি : মেহেরপুরে সৈয়দ আশরাফ। সাত-এর পাতায় এক কলামের সংবাদটির শিরোনাম সুরঞ্জিত পদত্যাগ করেছেন অপদস্থ হয়ে : আমিনী। আর উপ-সম্পাদকীয়র শিরোনাম ছিলো, সুরঞ্জিতের বিদায় ও কালো বিড়াল

এই সংবাদগুলো নিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে, সবগুলোই সাদামাটা প্রতিবেদন। সাংবাদিকতার ভাষায় যাকে বলে হার্ড-নিউজ। এ-ধরনের প্রতিবেদনে সংঘটিত বিষয়ের বাইরে বিশেষ কিছু থাকে না। ঘটনা ও ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত কিছু মানুষের প্রতিক্রিয়াই এসব প্রতিবেদনের মূল উপজীব্য। কিন্তু সুরঞ্জিতের বিরুদ্ধে যে-অভিযোগ তা বিরাজমান ব্যবস্থার অংশ বিশেষ। বিষয়টি এমন নয় যে, সবকিছুই ঠিক ছিলো; মাঝখান থেকে সুরঞ্জিত এই অপকর্মটি করে বসেছেন। বরং সামগ্রিক অপকর্মের ভিতর থেকে এটি-ই ঘটনাক্রমে চিহ্নিত হয়েছে কিংবা ফাঁস হয়েছে। এবং সংবাদপত্র সেই ফাঁস করা অংশ নিয়েই একেক দিন একেক রঙ লাগিয়ে আমাদের সামনে হাজির করেছে। শুধু এই ঘটনার ক্ষেত্রেই নয়; প্রায় সবগুলো ঘটনার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম কেবল খণ্ডিত বাস্তবতাই তুলে ধরে। সামগ্রিক বাস্তবতার ধারে-কাছে যাওয়ার আগ্রহ তাদের মধ্যে নেই বললেই চলে।

আবার মাঝে মাঝে দেখি, গণমাধ্যম জোর করেই একটা ঘটনার সামগ্রিক বাস্তবতার দিকে রওনা হয়। এই যেমন গেলো ডিসেম্বরে (২০১২) দিল্লিতে মেডিকেল-ছাত্রী ধর্ষণের বিষয়টি এর ভালো উদাহরণ। ওই ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে হঠাৎ করেই দেশিয় ধর্ষণের ঘটনা বেশি গুরুত্ব পেতে থাকে। দেখে মনে হয়, ধর্ষকগণ একজোট ছিলেন। ভারতের ঘটনার পরও বাংলাদেশি ধর্ষকগণ তাদের কাজকর্ম শুরু করেছেন। কিন্তু বিষয়টি মোটেও সে-রকম নয়। বাংলাদেশে এসব ঘটনা ধারাবাহিকভাবেই ঘটছিলো। কিন্তু গণমাধ্যমের তাতে আগ্রহী দৃষ্টি ছিলো না। যখন দেখলো, ধর্ষণকে ইস্যু করতে গেলে আরও কিছু কেইস দরকার তখনই দেশের ঘটনাগুলোকে আমলে নেওয়া শুরু করলো। এই কাজটি সুরঞ্জিতের বেলায় করা গেলো না; ইলিয়াসের বেলায় করা গেলো না? আর কিছু করলেও হঠাৎ ইলিয়াসের খোঁজ বাদ দিয়ে হিলারির পিছনে দৌড় শুরু হলো। তাই আমরা আজও জানতে (অন্তত এই লেখার সময় পর্যন্ত) পারলাম না বেচারা ইলিয়াস বেঁচে আছেন না মরে গেছেন। কিংবা সুরঞ্জিতের ঘটনায় জানতে পারলাম না, রেল খাতে আরও কী কী ঘটে এবং এদের সঙ্গে কারা কারা জড়িত। এবার সুরঞ্জিত সম্পর্কে কালের কণ্ঠ কী করেছে, প্রথম আলোর সঙ্গে আচরণ নিরপেক্ষ রাখতে তা-ও দেখা দরকার।

১৮ এপ্রিল সুরঞ্জিত ইস্যু নিয়ে কালের কণ্ঠ সংবাদ ছেপেছে মোট সাতটি ও উপ-সম্পাদকীয় দুটি। এরমধ্যে প্রথম পাতায় দিনের প্রধান সংবাদসহ রয়েছে পাঁচটি, শেষের পাতায় একটি, তিন-এর পাতায় একটি, উপ-সম্পাদকীয় একটি এবং ১৫-এর পাতায় একটি প্রতিক্রিয়ানির্ভর প্রতিবেদন রয়েছে।

প্রথম পাতায় প্রকাশিত ৫টি সংবাদের মধ্যে দিনের প্রধান সংবাদের শিরোনাম ছিলো পাঁচ কলামের। শিরোনাম ছিলো এপিএসদের কীর্তিকলাপ। এই পাতায় আড়াই কলামের দুটি সংবাদ ছিলো। শিরোনাম যথাক্রমে, বর্তমান প্রশাসনে কমপক্ষে ১৪ জনের দাপট তুঙ্গেচারদলীয় জোট আমলেও পিছিয়ে ছিলো না ওরা। তিন কলামের একটি সংবাদ ছিলো যার শিরোনাম ছিলো, সুরঞ্জিত দপ্তরবিহীন মন্ত্রী : তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত হলে তার বিষয়ে নতুন সিদ্ধান্ত। আরেকটি দুই কলামের শিরোনাম ইউসুফ মৃধা, ফারুক ও এনামুলকে দুদকে তলব

প্রথম পাতার সংবাদগুলো নিয়েই কথা বলা যেতে পারে। কারণ, প্রথম পাতায়ই সংবাদপত্রের প্রচেষ্টা ও গুরুত্বের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রতিফলিত হয়। ধরে নিলাম, এপিএসদের বিষয়ে যে-সংবাদ ছাপা হয়েছে, সেটি একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। কিন্তু সেই প্রতিবেদন মন্ত্রীকে মাঝখানে রেখে কাঠামোর নিচের দিকে যাওয়ার প্রচেষ্টা কেনো? তা উপরের দিকেও তো যেতে পারতো। সুরঞ্জিত তো এই কর্মের সর্বশেষ চূড়া নয়। আমাদের দৃষ্টিতে এই সংবাদের মর্মার্থ হলো, ওই কেলেঙ্কারির কাণ্ডে সুরঞ্জিতই মূল ও একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু। এবং তার আশেপাশের স্তরে কেবল এপিএসদেরই বসবাস। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এপিএসদের চেয়ার সুরঞ্জিতের চেয়ারের অনেক নিচের গ্যালারিতে। এখন নিচের গ্যালারি নিয়ে কথা কি বলা যাবে না? যাবে। কিন্তু শুধু নিচের গ্যালারি নিয়ে কেনো? সুরঞ্জিতের উপরের গ্যালারির লোকদের কথা কে বলবে? সাধারণত গ্যালারির উপরে যারা থাকেন, তারাই সেখান থেকে গ্যালারিতে ঘটে যাওয়া সব ঘটনার ভালো ওয়াচার হন।

 

৫.

এভাবে দিনের পর দিন এক প্রকার প্রতিবন্ধকতাহীনভাবেই গণমাধ্যম তাদের পথে চলছে। প্রতিবন্ধকতা থাকবে কীভাবে? কারণ, মিডিয়ার সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের যে দেনা-পাওনার সম্পর্ক, তা খুব কাছ থেকে না দেখলে বোঝার উপায় থাকে না। কিন্তু প্রশ্ন, কাছ থেকে দেখতে পারে কয়জন? প্রথম আলোর মালিক ট্রান্সকম এবং কালের কণ্ঠর মালিক যে বসুন্ধরা গ্রুপ-এ কথা কয় জনে জানে? এছাড়া পশ্চিমের মত একই হাউজ থেকে দৈনিক, সাপ্তাহিক আর টিভি চ্যানেল বের হচ্ছে। মহান পেশায় অবদান রাখা বা সমাজ উন্নয়নের চিন্তা নয় বরং মুনাফা অর্জন, রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ কিংবা কোম্পানির অন্য ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এখন কাগজ বেরুচ্ছে, টিভির চ্যানেল গজাচ্ছে। গণমাধ্যম নিজেই পরিণত হয়েছে বহুজাতিক কোম্পানিতে।

এখানে বিজ্ঞাপন থেকে মুনাফা অর্জনই প্রধান কারণ নয়। যে-ক্ষমতাটা আধিপত্য বিস্তারে কাজ করে সেটাই আসল। তাই তো দেশের তেল, গ্যাস, কয়লা কে নিয়ে গেলো, সাধারণ মানুষ কে মরলো, কে বাঁচলো তা নিয়ে ভাবার কোনো প্রয়োজন মূলধারার গণমাধ্যমের নেই। গণমাধ্যম জনসাধারণকে চিন্তা করতে দিতে চায় না। তারা বিরাজমান অবস্থার বিরোধীদের যতোটা না ভয় পায়, তার চেয়ে বেশি ভয় পায়-দীর্ঘমেয়াদি ন্যায্য চিন্তাশক্তিকে। কারণ, একটি বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা চলতে থাকলে শেষ দিকে গিয়ে কিছু সাধারণের না-দেখা দিক উন্মোচিত হতে পারে। তারা চায় না, সেই দিকগুলো উন্মোচিত হোক।

গণমাধ্যমের চরিত্র বোঝার জন্য আরেকটি বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে; সম্পাদকীয়তে। কারণ, পত্রিকার মতিগতি আপাত এই জায়গায় প্রকাশ হয়। এখান থেকেই মূলত ধারণা পাওয়া যায়, একটি নির্দিষ্ট ইস্যুতে সংবাদপত্র কী চায়। আলোচনার স্বার্থে ধরে নিলাম ইলিয়াস গুম হওয়ার কারণে সুরঞ্জিত সংবাদ হিসেবে তার মূল্য হারায়। কিন্তু সম্পাদকীয়তে তো এতো পীড়াপীড়ি থাকার কথা না। কিন্তু সম্পাদকীয়তে একই অবস্থা; সেখানেও কোনো নির্দিষ্ট অবস্থান নেই। একটা বিষয়ের মীমাংসা হলো কী হলো না, সে-বিষয়ে মাথাব্যাথা নেই তাদেরও। নতুন ইস্যুর জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেয় তারাও। নিচের আলোচনা দিয়ে অভিযোগটি মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করা যেতে পারে।

সুরঞ্জিত সেনের রেল কেলেঙ্কারির ঘটনায় প্রথম আলো-তে দুটি সম্পাদকীয় ও পাঁচটি উপ-সম্পাদকীয় এসেছে। ১৯ এপ্রিল সুরঞ্জিতের ইস্যু বিদায় নিলে ২০ ও ২১ এপ্রিল আসে আর দুটি উপ-সম্পাদকীয়। কিন্তু এরপর ১০ মে পর্যন্ত এ-বিষয়ে আর কোনো সম্পাদকীয় বা উপ-সম্পাদকীয় সংবাদপত্রটিতে দেখা যায়নি। কালের কণ্ঠর অবস্থা একই। ইস্যু চলাকালীন পত্রিকাটিতে একটি সম্পাদকীয় ও তিনটি উপ-সম্পাদকীয় আসে। এরপর ১৯, ২১ ও ২২ তারিখে একটি করে উপ-সম্পাদকীয় ছাপা হয়। তারপর আর কোনো খবর নেই।

ইলিয়াস ইস্যুর বেলায় কী হয়েছে তাও দেখি। প্রথম আলো-তে ১৯ এপ্রিল থেকে ৩ মে পর্যন্ত সম্পাদকীয় এসেছে আটটি, আর উপ-সম্পাদকীয় এসেছে ১০টি। ৪ মে হিলারি ইস্যু শুরু হতেই তা কমে দাঁড়ায় একটিতে; যা প্রকাশিত হয় ৬ মে। কালের কন্ঠ-এ ১৯ এপ্রিল থেকে ১১ মে পর্যন্ত ইলিয়াস ইস্যুতে সম্পাদকীয় এসেছে আটটি এবং উপ-সম্পাদকীয় এসেছে ছয়টি। যা হিলারি ইস্যুর পর থেকে কমে যায় উল্লেখযোগ্য হারে।

এখানে সংখ্যা নিয়ে কথা বলতে চাই না। বলতে চাচ্ছি, একটা ইস্যু চলাকালীন পত্রিকার নির্দিষ্ট কোনো অবস্থান থাকে না। যে-কারণে, ইস্যু পরিবর্তন হলে আগের ইস্যুর চাওয়া-পাওয়া ফেলে নতুন ইস্যুর দিকে দৌড় মারতে কোনো সমস্যা হয় না।

 

৬.

শুধু তাই নয়, মিডিয়া তাদের স্বার্থ উদ্ধারে যে-কোনো উপায়ে জনসাধারণের চিন্তা, কর্ম, মন-মানসিকতাকে ভুল পথে পরিচালনা করে। আমরা যে-গণমাধ্যমকে সত্যের প্রতীক হিসেবে ধরে নিশ্চিন্ত মনে তার কচকচানি শুনে-দেখে নিশ্চিন্ত মনেই বসে থাকি সেই সত্যিকারের গণমাধ্যমগুলো মূলত জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। জনগণকে অন্য যে কোনো কিছু করতে দাও কিন্তু আমাদের বিরক্ত করো না (আমরা মানে সেই মানুষগুলো যারা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে)। নিয়ন্ত্রণকারী জনগোষ্ঠী তাদের স্বার্থ-রক্ষায় গণমাধ্যমকে ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। মিডিয়ার যে দায়িত্বের কথা আমরা বলি তার কিঞ্চিত পালনের নিদর্শনও আমরা পাই না।

কারণ, একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর আওতায় চলছে গণমাধ্যম। গণমাধ্যমের এ-কাঠামো মালিকানা, ব্যবসা, বৃহৎ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ সংরক্ষণ, রাষ্ট্র ও শাসক-শ্রেণিসহ বিভিন্ন চলক দ্বারা প্রভাবিত। গণমাধ্যম তার নিজের প্রয়োজনে এক শ্রেণির ভোক্তা তৈরি করে নিচ্ছে। যাদের চাহিদার সীমারেখাও তারাই নির্ধারণ করে দিয়েছে। পাঠক, সংবাদপত্রে কী চায়? তারা কী পড়বে? কী ভাববে? তাদের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা-ও গণমাধ্যমের পূর্ব নির্ধারিত। আর এতে গণমাধ্যমের সুবিধা হলো তারা ইচ্ছামতো ইস্যু পরিবর্তন করতে পারবে। যে-টুকু ইচ্ছা সে-টুকু অডিয়েন্সের সামনে নিয়ে আসবে। এভাবে গণমাধ্যম তার সামাজিক দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।

শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যাকাণ্ড নিয়ে এতো হইচই হলো, অথচ প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও, কেউ না কেউ নিহত হচ্ছেন, গুম হচ্ছেন-তাদের নিয়ে কোনো কথা হচ্ছে না। এর কিছু কারণও আছে। প্রথমত, মিডিয়া শ্রেণিভিত্তিক সংবাদ পরিবেশন করে। যে-শ্রেণির সঙ্গে মিডিয়ার স্বার্থগত, ক্ষমতাগত সম্পর্ক যতো বেশি সে-ইস্যুগুলো ততো দ্রুত উঠে আসে। সম্পর্ক এখানে ভালোও হতে পারে, খারাপও হতে পারে। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যে ব্যক্তি বা গ্রুপের সঙ্গে শক্তিধর বৈদেশিক সম্পর্ক বিদ্যমান, মিডিয়া তাদের সংবাদ হাইলাইট করে ততো বেশি। তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক শক্তির পাশাপাশি দেশের শক্তিমানদের কথাও গণমাধ্যম মান্য করে। এবং তাদের সুবিধামতো প্রচার বা প্রকাশ করে। চতুর্থত, সাধারণ মানুষ হত্যার ব্যাপারে মিডিয়া নিরব। হয়তো সেটা মিডিয়ার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে না। কিন্তু যখনই কোনো বিশেষ ব্যক্তির ক্ষতি সাধন হয়, মিডিয়া আর্তনাদ করে ওঠে। এর পিছনে তথাকথিত দায়িত্বের চেয়ে স্বার্থের গন্ধই বেশি পাওয়া যায়। হয়তো এ-জন্যই গণমাধ্যম তার দৃষ্টিকে সবসময় সংকীর্ণ রাখে, আর ঘন ঘন ইস্যু পরিবর্তন করে।

 

লেখক : মাজিদ মিঠু ও মোহাম্মদ আলী মানিক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

mazid.mithu@gmail.com

manikmcjru@gmail.com

 

তথ্যসূত্র

১. চট্টোপাধ্যায়, পার্থ (১৯৯৬ : ৬৪); গণজ্ঞাপন; পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, ৬-এ রাজা সুবোধ মল্লিক স্কয়ার (নবম তলা), কলিকাতা-৭০০০১৩।

২. শেখর, ড. সৌমিত্র; সংবাদপত্রে বাংলা ভাষা : ভাষিক বিচ্যুতি; যোগাযোগ; সম্পাদনা-ফাহমিদুল হক, আ-আল মামুন; সংখ্যা-৮, ফেব্রুয়ারি-২০০৭, পৃষ্ঠা-১৬৯, রাজশাহী।

৩. এডওয়ার্ড বারনেস, উদ্ধৃত; চমস্কি, নোম (২০০৭ : ৭৯); মূলধারার গণমাধ্যম কিভাবে মূলধারা হয়ে ওঠে; ভাষান্তর-পার্থ প্রতীম দাস; গণমাধ্যমের রাজনৈতিক অর্থনীতি নয়া তথ্যযুগে পুঁজিবাদ আর গণতন্ত্র; সম্পাদনা-মুসতাক আহমেদ; এ এইচ ডেভেলপমেন্ট পাবলিশিং হাউজ, ১৪৩ নিউ মার্কেট, ঢাকা-১২০৫।

৪. ফেরদৌস, রোবায়েত (২০১১ : ৮৬); গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা ওয়াচারদের ওয়াচ কেন জরুরি; বাজারের যুগে মিডিয়া, সম্পাদনা-সুদীপ্ত শর্মা, জামশেদুল করিম; আদর্শ, ৩৮ বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০ ।

৫. প্রাগুক্ত; চমস্কি, নোম (২০০৭ : ৭১)।

 

বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৩ সালের জানুয়ারির ম্যাজিক লণ্ঠনের চতুর্থ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন